Thursday, October 3, 2024

হাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প

আমি তাকে এমন একটি প্রস্তাব দেব, যা সে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।’ ‘দ্য গডফাদার’ সিনেমার এই বিখ্যাত সংলাপ আসলে একটি হুমকি। যখন মাফিয়াপ্রধান কিছু বলেন, তখন তা অমান্য করার সুযোগ থাকে না।


শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন—উন্নয়ন, নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার? এটি ছিল একটি এমন প্রস্তাব, যা অস্বীকার করা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না।


কিন্তু গণতন্ত্রকে নিঃশ্বাসরোধ করে এবং মানবাধিকারের উপর আঘাত করে কি করে উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? শেখ হাসিনার তথাকথিত উন্নয়নের দাবিগুলোর পেছনে লুকানো বাস্তবতাগুলো তথ্যনির্ভর অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে উন্মোচন করা প্রয়োজন।


 ###মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)

জিডিপি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং অপব্যবহৃত উন্নয়নের সূচক। এটি হাসিনা শাসনের সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয় ছিল। হাসিনার মন্ত্রীরা প্রায়ই দাবি করতেন যে তাঁরা ২০০৯ সালে মাত্র ১০২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালে জিডিপি ৪৬০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছেন। এটি সত্যিই একটি বিরাট কৃতিত্বের মতো শোনায়! কিন্তু এটি আসলে একটি মিথ্যাচার। এখানে কিছু ফাঁক রয়েছে।


প্রথমত, এই তথ্যের সত্যতা কতটা নিশ্চিত? হাসিনার পতনের কয়েক সপ্তাহ আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল যে ব্যুরো প্রায় ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত তথ্য দেখিয়েছে। যদিও তারা দাবি করেছে যে এতে জিডিপিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না, তবুও এটি জিডিপির অন্যান্য উপাদানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।


দ্বিতীয়ত, জিডিপি শুধুমাত্র তখনই উন্নয়নের সূচক, যখন অধিকাংশ অর্থনৈতিক কার্যক্রম উৎপাদনশীল হয়। যখন সন্দেহজনক মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বাড়ে, তখন জিডিপি আকাশচুম্বী হতে পারে। কিন্তু এর ফলে জনগণের প্রকৃত কোনো উপকার হবে না। তাদের জীবনমান উন্নত হবে না, ভোগান্তি কমবে না। বরং জিডিপি নিয়ে আস্ফালন করা আসলে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের আরেকটি প্রয়াস, যা আজ জনগণ উপলব্ধি করেছে।

sheikh hasina
শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন—উন্নয়ন, নাকি গণতান্ত্রিক অধিকার? এ–ও ছিল এমন এক প্রস্তাব, যা বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না।


এগুলো ছাড়াও কিছু পদ্ধতিগত কূটকৌশলও রয়েছে। মূলত, জিডিপি যৌগিক সুদের মতো কাজ করে। যদি কোনো দেশের জিডিপি ১০০ টাকা হয় এবং তা ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে তা ১০৫ টাকা হবে। পরের বছরে একই হারে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে তা ১১০ টাকা নয়, ১১০.২৫ টাকা হবে। তাই ১৫ বছর আগের জিডিপির সঙ্গে তুলনা করে বড় সাফল্য দাবি করা সম্ভব নয়। সরকারগুলোর পারফরম্যান্স তুলনা করতে হলে বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার হিসাব করতে হবে।


অন্যদিকে, যখন জনসংখ্যা বাড়ে, তখন জিডিপিও বাড়ে। কারণ, জিডিপির সবচেয়ে বড় উপাদান হলো ব্যক্তিগত ভোগ। সহজ কথায়, যদি খাওয়ার জন্য বেশি মুখ থাকে, তবে পারিবারিক ব্যয়ও বেশি হবে এবং সেই ব্যয় জিডিপিতে যোগ হবে। তাই সময়ের সঙ্গে তুলনা করার জন্য মাথাপিছু জিডিপি ব্যবহার করা উচিত।


১৫ বছর আগের ১০০ টাকার একই মূল্য এখন আর নেই। তাই তুলনার জন্য বর্তমান দামে নয়, নির্দিষ্ট মূল্যের ভিত্তিতে জিডিপি মাপা প্রয়োজন।


বাংলাদেশ গত ১৫ বছরে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে (সম্ভাব্য তথ্য হেরফের সত্ত্বেও)। কিন্তু কোথায় সেই ব্যতিক্রমী উন্নয়ন? প্রকৃতপক্ষে, বিএনপি দুবার স্থবির অর্থনীতিকে চাঙা করেছে এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি বিএনপির সর্বশেষ মেয়াদের শেষের দিকে হয়েছিল। বিএনপি নিজেও হয়তো এ বিষয়ে সচেতন নয়।


প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হ্রাস দেখেছে, যথাক্রমে ৮ ও ৯ শতাংশ, ১৯৯১-৯৫ এবং ২০০০-০৫ সালের মধ্যে। উভয়ই ছিল আওয়ামী লীগ মেয়াদবহির্ভূত সময়ে বিএনপি শাসনামলে।


### আয়


শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতারা দাবি করেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশি মানুষের গড় আয় তিন গুণ বেড়েছে। এটা সত্য, কিন্তু কি এটা আসলে একটি ব্যতিক্রমী অর্জন?


বাংলাদেশের গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় সমীক্ষা ২০২২ প্রতিবেদন থেকে কিছু তথ্য দেখা যাক। ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ১২ বছরে গড় গৃহস্থালি আয় ১১,৪৭৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩২,৪২২ টাকায় পৌঁছেছে, অর্থাৎ আয় বেড়েছে ২.৮ গুণ। কিন্তু ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে, মাত্র ৫ বছরে আয় ৭,২০৩ টাকা থেকে বেড়ে ১১,৪৭৯ টাকায় পৌঁছেছিল, যা ১.৬ গুণ।


অন্যভাবে বললে, ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিভিন্ন সরকারের মিশ্র মেয়াদে গড় গৃহস্থালি আয় বছরে গড় ৯.৮ শতাংশ হারে বেড়েছিল। হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে, এটি বছরে গড় ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে। এই অর্জন কতটা ব্যতিক্রমী? 


এখন, ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে প্রতিদিনের জিনিসপত্রের দাম (ভোক্তা মূল্যসূচক অনুযায়ী) ২.১৬ গুণ বেড়ে গেছে এবং আয় বৈষম্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনি যদি এসব বিবেচনায় নেন, তবে বুঝতে পারবেন, স্বৈরাচারী শাসনামলে প্রকৃত আয়ের দিক থেকে সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আসলে আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছে।

### দারিদ্র্য


স্বৈরাচারী সরকার দাবি করেছে যে তারা দারিদ্র্যকে জয় করেছে এবং বাংলাদেশে গরিব মানুষ প্রায় বিলুপ্তির পথে। সত্যি বলতে, ২০১০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচনে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই সময়ের মধ্যে দৈনিক ২.১৫ ডলারের নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ১৮.২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে, অর্থাৎ প্রতি ৫ বছরে প্রায় ৫ শতাংশ হ্রাস। এটি সত্যিই প্রশংসনীয়, তবে এর বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ।


আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বিলুপ্তির বিনিময়ে কতটা দারিদ্র্য বিমোচন হয়েছে? প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হ্রাস দেখেছে, যথাক্রমে ৮ ও ৯ শতাংশ, ১৯৯১-৯৫ এবং ২০০০-০৫ সালের মধ্যে—যা ছিল বিএনপির শাসনামলে। এরপরেও হাসিনা সরকারের দাবি, শুধু তারাই বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখেছে।

### সারকথা


বিগত ১৫ বছরের তথাকথিত উন্নয়নের পরিসংখ্যানকে এক পাশে রেখে আমাদের এখন দেশের সেবা খাতের প্রকৃত অবস্থার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যেমন কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রপ্তানি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।


বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের কথাও উল্লেখ করা হয়, কিন্তু এটি মূলত জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল একটি সাময়িক সমাধান। এ ধরনের পরিকল্পনা দীর্ঘ মেয়াদে কেবল গলার কাঁটা হবে।


অনেকে অবকাঠামো খাতে শেখ হাসিনার অবদানের কথা বলেন। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্পের সুফল নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এই বিশাল মেগা প্রকল্পগুলোর বিপুল ঋণ শোধ করতে হবে, যার বড় অংশই দুর্নীতিতে ব্যয় হয়েছে।


মনে রাখতে হবে, সেতু, রাস্তা ইত্যাদির মতো প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে তোলা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও অনেক দেশ 'মধ্যম আয়ের ফাঁদে' আটকে পড়ে, কারণ তারা প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে না। পূর্ববর্তী সরকারের নানা কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।


শেয়ার করুন

0 coment rios: